পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৫

'Bongobani' by Abdul Hakim

বঙ্গবাণী 

আব্দুল হাকিম


 
কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস। 
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।। 
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন। 
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।। 
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ। 
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।। 
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত। 
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।। 
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ। 
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।। 
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী। 
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।। 
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন। 
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।। 
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। 
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।। 
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়। 
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।। 
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি। 
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

'Premiker protidondi' by Abul Hassan



প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী 

আবুল হাসান


অতো বড় চোখ নিয়ে, অতো বড় খোঁপা নিয়ে 

অতো বড় দীর্ঘশ্বাস বুকের নিশ্বাস নিয়ে 

যতো তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারশ 

যতো তুমি খুলে দাও ঘরের পাহারা 

যতো আনো ও-আঙ্গুলে অবৈধ ইশারা


যতো না জাগাও তুমি ফুলের সুরভী 
আঁচলে আগলা করো কোমলতা, অন্ধকার 
মাটি থেকে মৌনতার ময়ূর নাচাও কোন 
আমি ফিরব না আর, আমি কোনদিন 
কারো প্রেমিক হবো না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ 
আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো।

'Nishongota' by Abul Hassan


নিঃসঙ্গতা 

----আবুল হাসান


অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক! 

অতটা চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভিড়, অত সমাগম! 
চেয়েছিল আরো কিছু কম! 

একটি জলের খনি 
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল 

একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!

'Bristy chinhito bhalobasha' by Abul Hassan



বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা 

----আবুল হাসান



মনে আছে একবার বৃষ্টি নেমেছিল ? 

একবার ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থেমেছিল  

আমাদের ইস্টিশনে সারাদিন জল ডাকাতের মতো 

উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল তারা; 

ছোট-খাটো রাজনীতিকের মতো পাড়ায়-পাড়ায় 

জুড়ে দিয়েছিল অথই শ্লোগান।

তবু কেউ আমাদের কাদা ভেঙে যাইনি মিটিং-এ 
থিয়েটার পণ্ড হলো, এ বৃষ্টিতে সভা আর 
তাসের আড্ডার লোক ফিরে এলো ঘরে; 
ব্যবসার হলো ক্ষতি দারুণ দুর্দশা,

সারাদিন অমুক নিপাত যাক, অমুক জিন্দাবাদ 
অমুকের ধ্বংস চাই বলে আর হাবিজাবি হলোনা পাড়াটা।

ভদ্রশান্ত কেবল কয়েকটি গাছ বেফাঁস নারীর মতো 
চুল ঝাড়ানো আঙ্গিনায় হঠাৎ বাতাসে আর 
পাশের বাড়ীতে কোনো হারমোনিয়ামে শুধু উঠতি এক আগ্রহী গায়িকা 
স্বরচিত মেঘমালা গাইলো তিনবার !

আর ক’টি চা’খোর মানুষ এলো 
রেনকোট গায়ে চেপে চায়ের দোকানে; 
তাদের স্বভাবসিদ্ধ গলা থেকে শোনা গেল : 
কী করি বলুন দেখি, দাঁত পড়ে যাচ্ছে তবু মাইনেটা বাড়ছেনা, 
ডাক্তারের কাছে যাই তবু শুধু বাড়ছেই ক্রমাগত বাড়ছেই 
হৃদরোগ, চোখের অসুখ !

একজন বেরসিক রোগী গলা কাশলো : 
ওহে ছোকরা, নুন চায়ে এক টুকরো বেশী লেবু দিও।

তাদের বিভিন্ন সব জীবনের খুঁটিনাটি দুঃখবোধ সমস্যায় তবু 
সেদিন বৃষ্টিতে কিছু আসে যায়নি আমাদের 
কেননা সেদিন সারাদিন বৃষ্টি পড়েছিল, 
সারাদিন আকাশের অন্ধকার বর্ষণের সানুনয় অনুরোধে 
আমাদের পাশাপাশি শুয়ে থাকতে হয়েছিল সারাদিন

আমাদের হৃদয়ে অক্ষরভরা উপন্যাস পড়তে হয়েছিল !

'Ekla batash' by Abul Hassan


একলা বাতাস 

আবুল হাসান

নখের ভিতর নষ্ট ময়লা, 

চোখের ভিতর প্রেম, 

চুলের কাছে ফেরার বাতাস 

 দেখেই শুধালেম,

এখন তুমি কোথায় যাবে?

  কোন আঘাটার জল ঘোলাবে? 

কোন আগুনের স্পর্শ নেবে 

 রক্তে কি প্রব্লেম?

হঠাৎ তাহার ছায়ায় আমি যেদিকে তাকালেম 

 তাহার শরীর মাড়িয়ে দিয়ে 

 দিগন্তে দুইচক্ষু নিয়ে  

আমার দিকে তাকিয়ে আমি আমাকে শুধালেম

এখন তুমি কোথায় যাবে? 
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?  
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে 
রক্তে কি প্রব্লেম?

'Jotsnay tumi kotha bolcho na keno' by Abul Hassan

জ্যোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন 

----আবুল হাসান

প্রতিটি নতুন কথা বলাটাই হলো আমাদের প্রেম,
প্রতিটি নতুন শব্দই হলো শিল্পকলার সীমাঃ
হে অসীমা তুমি কথা বলছো না কেন ?
ওষ্ঠে কাঁপন ধরানোই হলো
নিবিড় নিহিত আবেগের চুম্বন।
এসো তবে ঠোঁটে কাঁপন ধরাই
দু’জনের ঠোঁটে দূরের কুজন, হাওয়া শনশন্ চুম্বন গড়ে তুলি।
একাকী থেকেও এখন আমরা এসো দু’জনের মুগ্ধতা আনি মুখে
কপালে কাঁপাই ভ্রূযুগল অনুভূতি।
বাতাসে বহাই চক্ষুর সম্মতি।
এসো সতী মেয়ে আবার আমরা শুয়ে পড়ি, সেতু বাঁধি
দুই শরীরের মিলনে ঐকতান,
সংরাগে দেই সুন্দর করতালিঃ
আমাদের দুটি হৃদয়ে আজকে প্রথম ধরেছে কলি,
এসো উদ্যানে পুষ্প পবনে অঙ্গার হয়ে জ্বলি।
সূর্যে তারায় শত শনশন সবুজ ডেরায় আমি তুলি ঝঙ্কার
কান পেতে তুমি তাই শোনো মৃত্তিকা,
এসো সুন্দর, এসো হে শহরতলী,
আমাকে বানাও ঘন সবুজের শিখা,
তুমি তো বনস্থলী,
তোমাকে কে চেনে আর
আমি ছাড়া আর কে জানে তোমার কেন এ অহঙ্কার,
কেন নিশ্চুপ, কথা বলছো না হৃদয়ে পূর্ণিমার
জ্যোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন।

'Protikkhar shokhgatha' by Abul Hassan


প্রতিক্ষার শোকগাথা 

----আবুল হাসান

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আর আমার হাত ঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে !

টুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী

এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো এ্যাসট্রেতে !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আজ স্বাতী ?

তোমার কথার মতো নরম সবুজ
কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ !

তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়

আর একটি অস্থির নীল প্রজাপতি পর্দার বুনট থেকে উড়ে এসে
ঢুকে গেছে আমার মাথায় !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসছোনা আজ স্বাতী ?

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আর স্বাতী ?

'Proshno' by Abul Hassan

প্রশ্ন 

---আবুল হাসান

চোখ ভরে যে দেখতে চাও
রঞ্জন রশ্মিটা চেনো তো?
বুক ভরে যে শ্বাস নিতে চাও
জানো তো অক্সিজেনের পরিমাণটা কত?
এত যে কাছে আসতে চাও
কতটুকু সংযম আছে তোমার?
এত যে ভালোবাসতে চাও
তার কতটুকু উত্তাপ সইতে পারবে তুমি?

'Akankha' by Abul Hassan

আকাঙ্খা 

----আবুল হাসান

 
তুমি কি আমার আকাশ হবে?
মেঘ হয়ে যাকে সাজাব
আমার মনের মত করে ।
 
তুমি কি আমার নদী হবে?
যার নিবিড় আলিঙ্গনে ধন্য হয়ে
তরী বেশে ভেসে যাব কোন অজানা গন্তব্যের পথে ।
 
তুমি কি আমার জোছনা হবে?
যার মায়াজালে বিভোর হয়ে
নিজেকে সঁপে দেব সকল বাস্তবতা ভুলে ।
 
তুমি কি আমার কবর হবে?
যেখানে শান্তির শীতল বাতাসে
বয়ে যাবে আমার চিরনিদ্রার অফুরন্ত প্রহর ।

'Aparup bagan' by Abul Hassan

অপরূপ বাগান 

----আবুল হাসান

চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল :
নদীর প্রবাহ পলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার- অনড় শামুক ! 

তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে ?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি- তা হলে এ চোখ 
মাথার খুলির নীচে নরম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি ? 

জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন ! 
তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি ! 

অনুপস্থিতি হবে আমার একলা ঘর, আমার বসতি ! 

ফিরে যাবো সংগোপনে, জানবে না, চিনবে না কেউ; 
উঠানে জন্মাবো কিছু হাহাকার, অনিদ্রার গান- 

আর লোকে দেখে ভাববে- বিরহবাগান ঐ উঠানে তো বেশ মানিয়েছে !

'Tomar chibuk chubo, kalima chubo na' by Abul Hassan


তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না

----আবুল হাসান

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’ শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখবো না! 

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো; তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন

তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো
কালিমা রাখবো না! 

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
এখন তোমার কাছে যাবো

তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা–
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো
আমি আঁধার রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভীর দুধের সাদা
হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত
যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না– তোমার চিবুকে
তারা নিশ্চয়ই আছেন! 

তোমার চিবুকে সেই গাভীর দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি 
কাছে আয় পুরনো রাখাল!
আমি কাছে যাবো আমি তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না!

'Bodle jao, kichuta bodlao' by Abul Hassan




বদলে যাও, কিছুটা বদলাও 

----আবুল হাসান


কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী 
কিছুটা বদলাতে হবে সুর 
সাতটি ছিদ্রের সূর্য; সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর 
কিছুটা বদলাতে হবে

মাটির কনুই , ভাঁজ রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে…

বদলে দাও, তুমি বদলাও
নইলে এক্ষুনি 
ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী , 
যখন যেখানে পাবে 
মেরে রেখে যাবে, 
তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও । 
বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও !

'Aparichiti' by Abul Hassan

অপরিচিতি 

আবুল হাসান


 
যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত! 
স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়
অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর
ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর
সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত 
আমার কেবলই শুধু রাত হয়ে যায়!

'Maa-go, ora bole' by Abu-Jafar Ubaidullah

মাগো, ওরা বলে 

----আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ



‘কুমড়ো ফুলে ফুলে 
নুয়ে পড়েছে লতাটা,  
সজনে ডাঁটায়  
ভরে গেছে গাছটা,  
আর, আমি ডালের বড়ি  
শুকিয়ে রেখেছি—  
খোকা তুই কবে আসবি!  
কবে ছুটি?’

চিঠিটা তার পকেটে ছিল,
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।

‘মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে 
তোমার কোলে শুয়ে 
গল্প শুনতে দেবে না। 
বলো, মা, তাই কি হয়? 
তাইতো আমার দেরী হচ্ছে। 
তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে 
তবেই না বাড়ী ফিরবো। 
লক্ষ্মী মা রাগ ক’রো না, 
মাত্রতো আর কটা দিন।’

‘পাগল ছেলে’ ,
মা পড়ে আর হাসে, 
‘তোর ওপরে রাগ করতে পারি!’

নারকেলের চিঁড়ে কোটে,

উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে 
এটা সেটা আরো কত কি! 
তার খোকা যে বাড়ী ফিরবে! 
ক্লান্ত খোকা!

কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে, 
ঝ’রে প’ড়েছে ডাঁটা; 
পুঁইলতাটা নেতানো,— 
‘খোকা এলি?’

ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে, উঠোনে 
যেখানে খোকার শব 
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।

এখন,
মা’র চোখে চৈত্রের রোদ 
পুড়িয়ে দেয় শকুনিদের। 
তারপর, 
দাওয়ায় ব’সে 
মা আবার ধান ভানে, 
বিন্নি ধানের খই ভাজে, 
খোকা তার 
কখন আসে! কখন আসে!

এখন,
মা’র চোখে শিশির ভোর, 
স্নেহের রোদে 
ভিটে ভরেছে।

'Ami kingbodontir kotha bolchi' by Abu-Jafar Ubaidullah

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি 

---আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

 
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মা’য়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মা’য়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
আমরা কি তা’র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা’র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
তিনি মৃত্তিকার গভীরে
কর্ষণের কথা বলতেন
অবগাহিত ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
সবত্সা গাভীর মত
দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।
যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
যূথবদ্ধ হলাম।
বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপে
মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
বারিসিক্ত ভূমিতে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
আনিঃশ্বাস গ্রহণ করলাম।
তখন বিষসর্প প্রভুগণ
অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যখন কবিকে হত্যা করা হল
তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।
তখন আমরা দুঃখকে ক্রোধ
এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।
নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্সারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।
আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
অভ্যূত্থানের কথা বলছি
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত
কমলের চোখের কথা বলছি
প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
আমি বহ্নমান মৃত্যু
এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।
যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের মত
ঋজু এবং সংহত হলাম।
পর্বত শৃংগের মত
মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
দিকচক্রবালের মত
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উত্পাটিত করলাম।
তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের
উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের
অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃংখলিত বৃক্ষের
উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
নিঃসঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
স্মরণ করলাম।
প্রপিতামহের বীর গাঁথা
স্মরণ করলাম।
আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
স্মরণ করলাম।
তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।
স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।
যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
সে কবি
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
সে কবি
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।
খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
শস্যের পরিচর্যা করছি।
আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমার সন্তানেরা
আমি তোমাদের বলছি।
যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
সূর্যের মত সত্য হবে
সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।
আমি বিষসর্প প্রভুদের
চির প্রয়াণের কথা বলছি
দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
পরিসমাপ্তির কথা বলছি
সুতীব্র ঘৃণার
চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।
আমি সুপুরুষ ভালবাসার
সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।
যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মত্স্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো 
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো ?

'Tui ki amar dukkho hobi?' by Anisul Haque


তুই কি আমার দুঃখ হবি 

----আনিসুল হক

তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া।
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি।

তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
নিজের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।

তুই কি একা আমার হবি?
তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?

শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৫

'Neerar pashe tinti chaya' by Sunil Gangopadhyay


নীরার পাশে তিনটি ছায়া 

– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


নীরা এবং নীরার পাশে তিনটি ছায়া   
আমি ধনুকে তীর জুড়েছি, ছায়া তবুও এত বেহায়া  
পাশ ছাড়ে না
বার ছিলা সমুদ্যত, হানবো তীর ঝড়ের মতো–  
নীরা দু’হাত তুলে বললো, ‘মা নিষাদ!  
ওরা আমার বিষম চেনা!’  
ঘূর্ণি ধুলোর সঙ্গে ওড়ে আমার বুক চাপা বিষাদ–  
লঘু প্রকোপে হাসলো নীরা, সঙ্গে ছায়া-অভিমানীরা
ফেরানো তীর দৃষ্টি ছুঁয়ে মিলিয়ে গেল  
নীরা জানে না!

'Ekmutho jonakee' by Purnendu Potree

একমুঠো জোনাকী 

–পুর্ণেন্দু পত্রী


একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে  
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।  
একমুঠো জোনাকীর আলো পেয়ে
ক একটা যুবক হয়ে যাচ্ছে জলটুঙি পাহাড় যু
বতীরা সুবর্ণরেখা।  
সাপুড়ের ঝাঁপি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী  
পুজো সংখ্যা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী।
কমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে  
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।  
ময়দানের মঞ্চে একমুঠো জোনাকী উড়িয়ে  
জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল যেন কারা।  
রবীন্দ্রসদনে তিরিশজন কবি তিরিশদিন ধরে আউড়ে গেল  
একমুঠো জোনাকীর সঙ্গে তাদের ভাব-ভালোবাসা।
ইউনেসকোর গোল টেবিল ঘিরে বসে গেছে মহামান্যদের সভা
একমুঠো জোনাকীর আলোয়  
আফ্রিকা থেকে আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত হোগলা বন আর ফাটা দেয়ালে  
সাজিয়ে দেবে কোনারক কিংবা এথেন্সের ভাস্কর্য।  
সাত শতাব্দীর অন্ধকার এইভাবে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজি দেখিয়ে চলেছে একমুঠো জোনাকীর আলোয়।

'Kotha ache' by Sunil Gangopadhyay

কথা আছে 

– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে চটি, ওপাশে শাড়ির পাড়ে
দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু
মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের শব্দ, দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী
দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ, একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে।

'Raatri' by Amiyo Chakrabarti

রাত্রি 

– অমিয় চক্রবর্তী

অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাত্ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোত্স্না,
দেখি তুমি নেই ||

'Pondoshrom' by Shamsur Rahman

পণ্ডশ্রম 

– শামসুর রাহমান


এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে। কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে, আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।

দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে, কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে। কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল? কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।

যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে, পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে। সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি, যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।

মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু, ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু! ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?

নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে; কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে। ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম? বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।

'Neelima' by Jibanananda Das

নীলিমা 

–জীবনানন্দ দাশ

রৌদ্র ঝিল্‌মিল,
উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
-উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
মরীচিকা-ঢাকা!
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল-
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল
তোমার ও মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী।
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
-শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে , শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!

বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

'Bidrohee' by Kazi Nazrul Islam


বিদ্রোহী 

----কাজী নজরুল ইসলাম



বল বীর – 
বল উন্নত মম শির! 
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির! 
বল বীর – 
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ 
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’ 
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া 
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, 
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর! 
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর! 
বল বীর – 
আমি চির উন্নত শির!
আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, 
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস! 
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, 
আমি দুর্বার, 
আমি ভেঙে করি সব চুরমার! 
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, 
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল! 
আমি মানি না কো কোন আইন, 
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন! 
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর 
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর! 
বল বীর – 
চির-উন্নত মম শির!
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, 
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। 
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, 
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। 
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, 
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ 
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ 
ফিং দিয়া দিই তিন দোল; 
আমি চপলা-চপল হিন্দোল। 
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, 
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, 
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! 
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; 
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! 
বল বীর – 
আমি চির উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ, 
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি, 
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি। 
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, 
আমি অবসান, নিশাবসান। 
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য 
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য; 
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর। 
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর। 
বল বীর – 
চির – উন্নত মম শির!
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক, 
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক। 
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, 
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ! 
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, 
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার, 
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড, 
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড! 
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য, 
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব। 
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস, 
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস! 
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী, 
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী! 
আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল, 
আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল, 
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি 
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি! 
আমি উন্মন মন উদাসীর, 
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর। 
আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের, 
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ – জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের 
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড় 
চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর! 
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন, 
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন! 
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর, 
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর! 
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া, 
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া। 
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি 
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! 
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ! 
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, 
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন। 
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া 
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে, 
তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার 
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল, 
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল! 
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ, 
আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি’ ভূমিকম্প।
ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’ – 
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’। 
আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল, 
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল! 
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী, 
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম 
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম 
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’ 
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। 
আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, 
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! 
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা, 
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা- 
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা! 
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি, 
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী! 
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী, 
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়, 
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়। 
আমি মানব দানব দেবতার ভয়, 
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়, 
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য, 
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য! 
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!! 
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার 
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! 
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে 
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে। 
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত 
আমি সেই দিন হব শান্ত, 
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না – 
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না – 
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত 
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, 
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! 
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! 
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর – 
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

'Rabindranath' by Al-Mahmud



রবীন্দ্রনাথ 

----আল মাহমুদ


এ কেমন অন্ধকার বঙ্গদেশ উত্থান রহিত নৈশব্দের মন্ত্রে 
যেন ডালে আর পাখিও বসে না।  
নদীগুলো দুঃখময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায়  
কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্যকোন শ্যামলতা নেই।
বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে 
ফের বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন।  

গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে
পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই
শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা  
আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি নিশ্চিত বিশ্বাস এই, 
একটিও উদ্ভিদ হবে না আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর!
অবিশ্বস্ত হাওয়া আছে, নেই কোন শব্দের দ্যোতনা,  
দু’একটা পাখি শুধু অশত্থের ডালে বসে আজও সঙ্গীতের ধ্বনি নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাক্যালাপ করে;  
বৃষ্টিহীন বোশেখের নিঃশব্দ পঁচিশ তারিখে।

'Esho he boishakh' by Rabindranath Tagore

এসো হে বৈশাখ এসো এসো 

----রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি, অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।  
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি, আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।

'Bhalobashar somoy toh nei' by Rudro Muhammad Shahidullah

ভালবাসার সময় তো নেই 

----রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ


ভালবাসার সময় তো নেই ব্যস্ত ভীষন কাজে, হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।

ঘামের জলে ভিজে সাবাড় করাল রৌদ্দুরে, কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।

কাজের মাঝে দিন কেটে যায় কাজের কোলাহল তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।

নদী আমার বয় না পাশে স্রোতের দেখা নেই, আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।

তোমার দিকে ফিরবো কখন বন্দী আমার চোখ পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।

'Bojhapora' by Rabindranath Tagore

বোঝাপড়া
 -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনেরে আজ কহো? যে
ভাল মন্দ যাহাই আসুক
সত্যরে লও সহজে ||
 
যাহার লাগি চক্ষু বুঁজি

তাহারে বাদ দিয়াও দেখি
বিশ্ব-ভূবন মস্ত ডাঙ্গর ||

খুব খানিকটা কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া


মনের সাথে কোনরকম
করে নে ভাই বোঝাপড়া ||

'Beche achi swapnomanush' by Mohadev Shaha

বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ 

– মহাদেব সাহা


আমি হয়তো কোনোদিন কারো বুকে
জাগাতে পারিনি ভালোবাসা,
ঢালতে পারিনি কোনো বন্ধুত্বের
শিকড়ের একটু জল-
ফোটাতে পারিনি কারো একটিও আবেগের ফুল
আমি তাই অন্যের বন্ধুকে চিরদিন বন্ধু বলেছি;
আমার হয়তো কোনো প্রেমিকা ছিলো না,
বন্ধু ছিলো না,
ঘরবাড়ি, বংশপরিচয় কিচ্ছু ছিলো না,
আমি ভাসমান শ্যাওলা ছিলাম,
শুধু স্বপ্ন ছিলাম;
কারো প্রেমিকাকে গোপনে বুকের মধ্যে
এভাবে প্রেমিকা ভেবে,
কারো সুখকে এভাবে বুকের মধ্যে
নিজের অনন্ত সুখ ভেবে,
আমি আজো বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ।
তোমাদের সকলের উষ্ণ ভালোবাসা, তোমাদের
সকল প্রেম
আমি সারি সারি চারাগাছের মতন আমার বুকে
রোপণ করেছি,
একাকী সেই প্রেমের শিকড়ে আমি
ঢেলেছি অজস্র জলধারা।
সকলের বুকের মধ্যেই একেকজন নারী আছে,
প্রেম আছে,
নিসর্গ-সৌন্দর্য আছে,
অশ্রুবিন্দু আছে
আমি সেই অশ্রু, প্রেম, নারী ও স্বপ্নের জন্যে
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি;
সকলের বুকের মধ্যে যেসব শহরতলী আছে,
সমুদ্রবন্দর আছে
সাঁকো ও সুড়ঙ্গ আছে, ঘরবাড়ি
আছে
একেকটি প্রেমিকা আছে, প্রিয় বন্ধু আছে,
ভালোবাসার প্রিয় মুখ আছে
ভালোবাসার প্রিয় মুখ আছে
সকলের বুকের মধ্যে স্বপ্নের সমুদ্রপোত আছে,
অপার্থিব ডালপালা আছে
আমি সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, সেই স্বপ্ন
সেই রূপকথার
জীবন্তমানুষ হয়ে আছি;
আমি সেই স্বপ্নকথা হয়ে আছি, তোমাদের
প্রেম হয়ে আছি,
তোমাদের স্বপ্নের মধ্যে ভালোবাসা হয়ে আছি
আমি হয়ে আছি সেই রূপকথার স্বপ্নমানুষ।

'Rekhe dio' by Mohadev Shaha

রেখে দিয়ো 

–মহাদেব সাহা

এখানে তোমাদের এই অশ্রুহীন চোখ,
কয়েক লাইন বিদ্যা মুখস্থ করা গম্ভীর মুখ
আর মলাট চিবানো দাঁত দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত;
আমি তাই হাত বাড়িয়ে আছি তাদের দিকে
যারা ডোবা বিল আর পুকুরে পদ্মফুল ফোটায়,

বাংলা সন-তারিখ দিয়ে চিঠি লেখে;

আমি তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছি, যদি পার
একগুচ্ছ তৃণ আর একফোঁটা অশ্রু
আমার জন্য রেখে দিয়ো;
আমি তার গন্ধে মৃত্যুলোক থেকে জেগে উঠতে পারি।

আজ আর আমার শহরের এই অন্ধ
ফুটপাতের কাছে,
এই সব মুখোশ-পরা মুখের কাছে
কিছুই চাওয়ার নেই;
দাঁত আর নখের গর্বে যারা মত্ত তারা কেন
আমার জন্য কখনো চোখের জল ফেলতে যাবে?


তোমরা যারা ডোবা-বিল খেতখামারের লকলকে
ঘাসের মধ্যে ডুবে আছ,
তোমরা যারা গায়ে মাখ পাকা ধানের গন্ধ,
তাদের বলি, আমার জন্য রেখে দিয়ো
একফোঁটা অশ্রু।